খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  ইসি পুনর্গঠনে নির্বাচন কমিশনের সামনে আগামীকাল বেলা ১১টায় এনসিপি’র বিক্ষোভ কর্মসূচি
  এই নির্বাচন কমিশনের উপর আস্থা রাখা যায় না : আখতার হোসেন
  ইসি পুনর্গঠন করে স্থানীয় নির্বাচন দিতে হবে : নাহিদ
  চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে না দিতে হাইকোর্টে রিট ; শুনানি রোববার
  অনুর্ধ্ব-১৮ নারী টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে রংপুরকে ৩ উইকেটে হারিয়ে খুলনার জয়

প্রত্নতাত্ত্বিক নৃত্য

রুশাইদ আহমেদ

রাত দুইটার দিকে এস্টিমেইটেড অ্যারাইভাল টাইমের চেয়ে এক ঘণ্টা বিলম্বে জেনিনকে ঢাকার কুড়িল বিশ্বরোডে নামিয়ে দিলো একটি বাস। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যান থেকে নামার সঙ্গে-সঙ্গে তাপমাত্রার তারতম্যে ঘোলা হয়ে উঠলো তার চশমার কাচ। হেমন্তের মধ্যরাতে চশমাটা ওড়না দিয়ে মুছে নিয়ন বাতির ছায়ায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করলো কোনো সিএনজি বা রিক্সার জন্য।

মিনিট দশেকের মাথায় ভাড়া নিয়ে ঈষৎ দর কষাকষি করে একটা রিক্সায় চড়ে বসলো জেনিন৷ গন্তব্য বড় বোন নাজমার নিউ ইস্কাটনের ফ্ল্যাট।

বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় নামে রাজশাহীর একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করেছে তাসনিম জারা জেনিন। ঢাকা থেকে বিদেশগমনের জন্য পড়াশোনার প্রস্তুতি নিতে বোনের বাসায় কয়েকমাস থাকার পরিকল্পনা নিয়েই মূলত: তার ঢাকার বুকে পা রাখা।

জেনিন তার লাগেজগুলো নিয়ে যখন নাজমার বাসায় পৌঁছালো, তখন মোটামুটি আড়াইটা পার হয়েছে। ইতিমধ্যে লবণাক্ত ঘামবিন্দুরা তার ফর্সা কপাল, গলা, কাঁধ, বুক আর পিঠে ভিড় জমিয়েছে। হেমন্তের রাত হলেও রাজধানীর দূষিত বায়ু দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে উষ্ণ হওয়ায় তার এই হাল।

ভবনটিতে রাত একটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত লিফট বন্ধ থাকে। অগত্যা তিনটে লাগেজ নিয়ে একাই নাজমার তিনতলার ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছে দুবার কলিং বেল টিপলো জেনিন। তৃতীয়বার টিপতে যাওয়ার আগেই আচমকা দরজা খুলে তার সামনে দাঁড়ালো হাইশাম।

আরে জেনিন! এই মাঝরাতের মহানগরীতে একা একা এ বাসায় চলে এলে কীভাবে? বলল হাইশাম।

মধ্যরাতে হুতুম পেঁচা যেভাবে গাছ পাল্টায়— সেভাবে! হাস্যরসাত্মকভাবে বলতে চেষ্টা করলো জেনিন।ঠিক আছে। ভেতরে এসো। তোমার আসার কথা ভাবি রাতে খাওয়ার সময়েই বলে রেখেছিল। বলেছিল কল করে জেনে নিতে কোথায় আছো। কিন্তু ফুটবল ম্যাচ দেখতে দেখতে আমি ভুলে গেছি। একটু লজ্জা পাওয়ার ভাব করলো হাইশাম।
জেনিন বলল, ইট’স ওকে।

হাইশাম মাহমুদ ন্যাটস্প্রিং নামের এনজিওর কর্মকর্তা নাজমা আনানের দেবর। থাকে পাশের ফ্ল্যাটে। সে পুরোনো এক জাতীয় পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার সাড়া জাগানো কবিতার বইও বেরিয়েছে দু-তিনটে। দেশের উদীয়মান কবিই বলা যায় তাকে। কবিতা আর ফুটবল তার নেশা। স্মার্টফোনে ফুটবল দেখা পছন্দ করে না বলে মাঝে মাঝে পত্রিকা অফিস থেকে ফিরে নাজমা আর তার বড় ভাই আরাফাতের অ্যাপার্টমেন্টের বড় ডাইনিং স্পেসের সোফায় শুয়ে-বসে খেলা উপভোগ করে মধ্যরাত পর্যন্ত।

যাহোক। ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকেই শু র‍্যাকের পাশে লাগেজগুলো রেখে ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে বসে পড়লো জেনিন। তার কপাল ও কাঁধের মুক্তোর দানার মতো ঘামবিন্দুগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে ফ্যানের রেগুলেটর বাড়িয়ে দিলো হাইশাম।

জেনিন প্রশ্ন করলো, আপা কোথায়?
তোমারও আমার মতো হঠাৎ হঠাৎ ভুলে যাওয়ার স্বভাব আছে মনে হচ্ছে। গত মঙ্গলবারই যখন ভাবিকে তোমার আসার কথা বলছিলে, তখনই তো তিনি বলেছিলেন—“এসে আমার ফ্ল্যাটে থাকিস। আমি তোর দুলাভাইয়ের ডিপার্টমেন্টের ট্যুরে যাচ্ছি। বৃহস্পতিবার রাতেই রওনা হবো শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশে।…” ধীর-স্থিরভাবে বলল হাইশাম।

তাহলে সব জেনেও আপনি এই ফ্ল্যাটে এসে বসে আছেন কেন, হুম? পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো জেনিন। এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও জেনিনের এই কথায় এবার তার কাছে গিয়ে বসলো হাইশাম। চোখে চোখ রেখে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ফুটবল আর কবিতার বাইরে আমি কখনো অন্য কোনো নেশায় মজিনি! তাই এসব অহেতুক প্রশ্ন করা তোমার ঠিক নয়।

হো হো করে হেসে উঠে জেনিন বলল, তাই বুঝি? আপনি তাহলে মধ্যরাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের প্রভাষক আপনার বড়ভাই আরাফাত হকের মতো কোনো নারীর ‘প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন’-এর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেন না?

জেনিনের এ ধরনের মশকরায় হাইশামের চেহারা লাল হয়ে উঠলেও পরক্ষণেই সে জবাব দিলো, এসব কূটনৈতিক আলাপ বাদ দাও। চা খাবে?

জেনিনের সম্মতি পেয়ে হাইশাম পুরুষসুলভ ভঙ্গিমায় রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল। সে দিকে একবার তাকিয়ে জেনিন আপন মনে
স্মৃতির মৃদু কম্পন অনুভব করলো।

বছর পাঁচ-ছয় আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে ঢাকায় এসে অ্যাডমিশন কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিল সে। কিন্তু সাধারণ জ্ঞান বিষয়টা তার ভালো লাগতো না মোটেও। তাই অবসরে ওই টপিকের পড়াশোনায় তাকে সহায়তা করতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হাইশাম।

জেনিনের স্মৃতি রোমন্থন সম্পূর্ণ না হতেই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো হাইশাম। জার্নি করে এসেছো তুমি। চা খেলে ঘুমাতে পারবে আর রাতে? কাপ এগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো সে।

জেনিন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল, ঢাকার মধ্যরাতগুলো বোধহয় ঘুমানোর জন্য নয়!

কোনো প্রত্যুত্তর করলো না হাইশাম।

জেনিনই আবার বলল, আমি কিন্তু আপনার কলেজ লাইফে গণিত করতে বসে কবিতা লেখার গল্পগুলো ভুলি নাই।
হাইশাম একটু ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল, এজন্যই তো জীবনের জটিল গাণিতিক হিসাব আর আমার মেলে না এখন!
সে না মিলুক। আজ আমরা তো এখানে মিলেছি বহু বছর পর। কাঁধ, বুক সোজা করে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে বলল জেনিন।

হ্যাঁ, তো কী হয়েছে? ধেই ধেই করে নাচব এখন সেজন্য? ঈষৎ রূঢ় হওয়ার চেষ্টা করলো হাইশাম।
সশব্দে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হেসে জেনিন বলল, না। তার দরকার নেই। বরং আপনি কবিতা বা গানের ছন্দ তুলুন— আমিই পরিবেশন করি ‘প্রত্নতাত্ত্বিক নৃত্য’।
বিরক্ত হয়ে হাইশাম বলল, তুমি পারোও বটে, জেনিন! কেন আমার সঙ্গে এমন করছো? কী ক্ষতি করেছি আমি তোমার?
জবাবে জেনিন বলল, পাঁচ বছর ধরে আমি আপনার কাছ হতে কোনো সাধারণ জ্ঞান শিখতে পারিনি। এটাই আমার ক্ষতি!

এরপরই হঠাৎ এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলো হাইশাম। ত্বরিতগতিতে সে জেনিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দুজনের নিঃশ্বাসকে এক সরলরৈখিক রজ্জুতে আবদ্ধ করে রাখলো কয়েক মুহূর্ত! হাইশামের আকস্মিক এই প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা হতভম্ব হলো জেনিন। তবে সে নিশ্চুপই হয়ে রইল।

এরপর জেনিনকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। বলল, ভাবি আর ভাই ফিরে এলে খোলাখুলি সব বলব তাদের। এখন যাও ঘুমাও। আমি আমার অ্যাপার্টমেন্টে যাচ্ছি। বিশেষ সাময়িকীর কিছু গল্প-কবিতার পাণ্ডুলিপি এখনও দেখা বাকি। বলেই পাশের ফ্ল্যাটে চলে গেল সে।

তখনও জেনিনের চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে। যেন চায়ের দারুণ গাঢ়ত্বে নৃত্য করছে অসংখ্য উষ্ণ বাষ্পবিন্দু!

খুলনা গেজেট/এমএনএস




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!